সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের মতোই একই কায়দায় রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছিল নাজিমউদ্দীন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন।
বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেন আরডিসি নাজিমউদ্দীন। একই কায়দায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ মানুষকে নানা অজুহাতে ধরে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল ও পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি।
ভুক্তভোগী এসব মানুষ তার এসব অপকর্মের শাস্তিসহ নিজেদের প্রতি অবিচার করায় সরকারের কাছে ন্যায় বিচার চান।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের পঞ্চায়েত পাড়ার কৃষক খালেকুজ্জামানের বাড়িতে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে তাণ্ডব চালান নাজিমউদ্দীন। ওই ইউনিয়নের দেবীকুড়া নামক বিল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের যোগসাজসে খালেকুজ্জামানের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে দরজা, জানালা ভেঙে তাকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন। এসময় তাদের বাধা দিতে গেলে তার স্ত্রী, সন্তান ও নাতিসহ পার্শ্ববর্তী অনেককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ লাঠিপেটা করেন।
পরে কৃষক খালেকুজ্জামানকে গাড়িতে তুলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেয়ার পথে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় জেলে দেয়ার হুমকি দেন। সে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মধ্যরাতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচ তলায় একটি রুমে বসিয়ে ছয় মাসের জেল প্রদান করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে আরডিসি নাজিমউদ্দীনের হাতে নির্যাতিত বিশ্বনাথের স্ত্রী, সন্তান ও তার ভাইসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জেলা প্রেস ক্লাবে এসে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। কিছুদিন আগে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের একটি জলমহাল ইজারার ঘটনায় মৎস্যজীবী বিশ্বনাথকে একই কায়দায় মধ্যরাতে বাড়িতে গিয়ে ঘর থেকে বের করে কিল ঘুষি মেরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় তাকে দুই বছরের জেল প্রদান করা হয়। বিশ্বনাথ জেলে থাকলেও এখন পর্যন্ত সে মামলার কোন কোন কপি হাতে পাননি তার পরিবার।
এ ব্যাপারে খালেকুজ্জামান মজনু জানান, ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা সময় হঠাৎ করে বাড়ির দরজায় লাথি মেরে দরজা ভেঙে আমাকে ঘর থেকে বের করে আনে। আমি আরডিসি নাজিমউদ্দীনের কাছে জানতে চাই এতো পুলিশ নিয়ে এসেছেন আমার কি অপরাধ। কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে বলে একে এরেস্ট কর।
তারপর দুইজন বিজিবি আমার দুই হাত দুই দিকে ধরে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে তোলার পর আমার মাথায় যে টুপি ছিল সে টুপিটা খুলে ফেলে দেয়। এরপর অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আমাকে বলে তোমার কাছে দুই লাখ টাকা আছে। যদি টাকা থাকে দাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। তখন টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে এরপর ডিসি অফিসের নিচ তালায় আমাকে নিয়ে একটি রুমে বসিয়ে বলা হয় তোমাকে ছয় মাসের জেল দেয়া হয়েছে। কোন প্রধানমন্ত্রী তোমাকে বাঁচায় দেখা যাবে। আমি সরকারের কাছে এর ন্যায় বিচার চাই।
কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে নির্যাতিত বিশ্বনাথের স্ত্রী পারো বালা দাস জানান, আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে মারপিট করে জেলে দিয়েছে। আমার দুটি ছোট সন্তান পা ধরলেও তারা ছেড়ে দেননি। এমনকি আমার ছোট ছোট বাচ্চা দুটিকেও লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে এই ম্যাজিস্ট্রেট। আমাকে গালি দিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেছে। আমি তাকে বাপ ডাকলেও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েন নি। তখন আমাকে বুট জুতা দিয়ে লাথি মারেন। এরপর প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসলে তাদেরকেও মারধর করা হয়।
স্বামীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ কোথায় যাবো। আমার স্বামীকে ছেড়ে না দিলে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে কি খাব। আমার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হোক।’
এ ব্যাপারে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফি জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে ভিতরবন্দ ইউনিয়নে অনেক সাধারণ মানুষকে আরডিসি নাজিমউদ্দীন এভাবে হয়রানি করেছে । এসব ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেন তিনি।
জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগদান করেন ২৭ নভেম্বর ২০১৯ সালে। রাজস্ব, এলএ, ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং আরএম শাখার দায়িত্ব পালন করেন করেন তিনি। যোগদানের পর থেকেই জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করেন আরডিসি নাজিমউদ্দীন।
এছাড়া কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি কমিশনার থাকাকালীন নানা অপকর্মে জড়িত থাকায় তাকে সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছিল। সেসময় তিনি কক্সবাজার শহরের কলাতলি এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নকু মাঝি (৬২) নামে এক বৃদ্ধকে নির্যাতন করার ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
অন্যদিকে শুধু প্রত্যাহার নয় জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন করেছে ছাত্র, যুব সমাজ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন।
সোমবার কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে এসব মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় বক্তারা বলেন, ‘শুধু ডিসি বা আরডিসিসহ জড়িতদের প্রত্যাহার নয় মধ্যরাতে নিরপরাধ সাংবাদিককে তুলে এনে নির্যাতন ও মাদকের মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর ঘটনায় সুষ্ঠ তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
উল্লেখ্য, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট আনসার সদস্যদের নিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের শহরের চড়ুয়া পাড়ার বাড়িতে যায়। এক পর্যায়ে জোড়পূর্বক দরজা ভেঙে তার ঘরে প্রবেশ করে স্ত্রী সন্তানের সামনেই তাকে মারধর করে ধরে নিয়ে যায়। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতনের পর তার বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা রাখার অভিযোগে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ ঘটনার একদিন পর জামিন পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দেন নির্যাতিত সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম।
এদিকে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনায় সোমবার আরডিসি নাজিমউদ্দীনসহ দুই সহকারী কমিশনারকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করে নতুন প্রশাসক হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাজিমউদ্দীনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।